>

কমলেন্দু চক্রবর্তী

SongSoptok | 5/15/2015 |




এবার একটু অন্য এক দলের কথা বলি ৷ সারা উওরবঙ্গে এই একদল সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকত ৷ সেটা হল ছাড়পোকা ৷ উওরবঙ্গে এমন কোনো লোক ছিল বলে মনে হয় না,যার গায়ে ছাড়পোকা কামড়ের দাগ নেই ৷ শিব্রাম চক্রবর্তীর বেতন নিবারণি শয্যা সবার ঘরেই থাকত ৷ আর সবাই ছিল এক একজন মন্টুর মাস্টার৷ কাঠের ফাঁকে ঘাপটি মেরে বসে থাকত সব নীরিহ গোবেচার মত ৷ যেই তোমার শরীরটা বিছানায় পড়ল ৷ শুরু হয়ে গেল ওদের কাজ ৷ চারিদিক থেকে চুপি সারে বেরিয়ে আসত সব ৷ আর শুরু হত আক্রমণ ৷ সামান্য কয়েকটা ছাড়পোকা এক এক জনকে সারা রাত জাগিয়ে রাখতে পারত ৷ সে তুমি যতো বড় পালওয়ানই হও ৷ রাতে ওদের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যেত ৷ ছাড়পোকা শুধু বিছানায় থাকত না ৷ যে কোনো আসবাবপএ বিশেষ করে কাঠের চেয়ার টেবিল এমন কি রেলের আরাম কেদারা,রেলের বসার সীট সব জায়গাতেই ওদের আধিপত্য ৷ বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় ওদের দেখা পাওয়া যেত না ৷ কিছুক্ষণ শুরু হত জব্বর কামড় ৷ আমরা হাত দিয়ে ছাড়পোকা মারতাম ৷ কিন্তু এইভাবে যুদ্ধে ওদের সঙ্গে কেউ পারত না ৷ ছাড়পোকা ধ্বংস করার তেমন কোনো সহজ বুদ্ধিও ছিল না ৷ সে সময় পএিকার মাথার উপর বিজ্ঞাপন থাকত ‘Tick 20’৷ কিছুটা কাজ হত কিন্তু সাময়িক ৷

ছাড়পোকার সঙ্গে যুদ্ধে হারতে হারতে আমরা ওদের কথা মাথা থেকে বের করে দিতাম ৷ আমরা হার স্বীকার করে ওদের হাতেই নিজেদের সপে দিতাম ৷ কারণ আমরা বুঝেগিয়েছিলাম যে ছাড়পোকার কামড় আমাদের ভবিতব্য ৷ একবার পাশের বাড়ির লোকজন দুদিন থাকবে না বলে আমাদের কাউকে রাতে থাকতে বলেছিল পাহারাদার হিসাবে ৷ আর এসব কাজের জন্য প্রথমেই ডাক পড়ত আমার ৷ আমি ছিলাম এসব কাজের বলির পাঁঠা ৷ রাতে ওদের ঘরে ঢুকে দেখি সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো বিছানা ৷ বাড়িতে আমাকে সবসময় সেজদার সঙ্গে বা অন্যদের সঙ্গে বিছানা ভাগ করে শুতে হত ৷ কিন্তু আজ আমি একা এত সুন্দর বিছানায় ঘুমাবো বলে ভাল লাগছিল ৷ শুয়েও পড়লাম চটপট আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝে গেলাম আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে ৷ আমাদের বিছানায় যা ছাড়পোকা থাকে এখানে তার চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশী ৷ যারা রাত বসেছিলাম ৷ আর সকালের অপেক্ষা করছিলাম ৷ পরদিন আর যাইনি ৷ ছাড়পোকা বেশী ছিল চ্যাংড়া বান্ধায় ৷ দোমহনীর পর আমাদের বদলি হল চ্যাংড়া বান্ধায় ৷ চ্যাংড়া বান্ধা নামটা আমার একেবারেই পছন্দ ছিল না ৷ কেমন যেন মানেটা ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ নামটার সঙ্গে আমার নামটা সারাজীবনের জন্য জড়িয়ে গেল ৷ আমি ওখানকার স্কুল থেকেই স্কুল ফাইনাল(এখানকার মাধ্যমিক) পাশ করেছিলাম ৷চ্যাংড়া বান্ধা কোচবিহার জেলায় ৷ রেলওয়ে স্টেশন থেকে আধমাইল দূরে তখনকার ইস্ট পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বর্ডার ৷ বর্ডারের প্রথমেই ঐ দেশের স্টেশন বুড়িমাড়ি ৷ শুনেছি বুড়িমারির করুণ অবস্থা ৷ সারাদিন একটা ট্রেন চ্যাংড়া বান্ধা হয়ে ইস্ট পাকিস্তানে যেত আর আসত ৷ বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিল আমাদের স্কুল ৷ 

চ্যাংড়া বান্ধায় প্রথম বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি পেলাম ৷ এ এক ভারি মজা ৷ সুইচ টিপলেই আলো জলে ৷ আলো থাকলেও কোনো ফ্যানের ছিল না আর বাড়িটাও ছিল অদ্ভূত ৷ বাংলো ধরনের বাড়ি ৷ বাঁশের বেড়ার উপর সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া বাড়ি ৷ বাইরে থেকে দেখলে সিমেন্টের বাড়ি বলে মনে হত ৷ ছাদটা ছিল অ্যাসবেসটাসের ৷ বাড়ির সবচাইতে বড় আর্কষণ ছিল ইলেক্ট্রিসিটি ৷ জীবনে এই প্রথম হাতের কাছে ইলেকট্রিকের আলো ৷ ওহো,গরুদের কথা তো একদম ভুলেই গিয়েছিলাম ৷ বামনহাটে আমাদের বাড়িতে বাবা গরু এনেছিল ৷ সেখান থেকে দোমহনী আর এখন চ্যাংড়া বান্ধা ৷ রেলের স্টাফ হিসাবে আমাদের মালপএ নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা মালগাড়ির ভ্যান পাওয়া যেত ৷ আর সঙ্গে গরু নেওয়ার জন্য আলাদা একটা ভ্যান পাওয়া যেত ৷ গরুগুলোকে কাঠের পাটাতনের সাহায্যে গাড়িতে তোলা হত ৷ গাড়ির ভিতরে বাঁশের ঘেরা দেওয়া হত ৷ বাঁশের গার্ড থাকত দরজাতেও ৷ কারণ  দরজা বন্ধ করা যাবে না ৷ এরপর গরুর খাওয়ানোর জন্য বেশী করে খড়, খোল ইত্যাদি দেওয়া হত ৷ আর গাড়িতে থাকত একজন লোক ৷ ওদের দেখাশোনা করার জন্য ৷ আমরা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যেতাম বসে আগেই পৌঁছে যেতাম,আর মালগাড়ির সঙ্গে জুড়ে থাকার জন্য গরুরা প্রায় এক-দেড় দিন পরে আসত ৷ 

চ্যাংড়া বান্ধার নতুন বাড়িতে আসার পরে আমাদের প্রথম কাজ হল গরুর ঘর তৈরী করা এক আধজন বাইরের লোকের সাহায্য নিয়ে আমরা নিজেরাই টিন বাঁশের বেড়া দিয়ে গোয়াল ঘর বানাতাম ৷ মেজেতে ইট পেতে দিতাম ৷ শীতকালে বস্তার জামা পড়াতাম ৷ মশার জন্য ধুনো দিতাম ৷ খাবার দেওয়া,জল দেওয়া,স্নান করানো এসব আমরা নিজেরাই করতাম ৷ এমন কি গোয়াল ঘরের গোবর বের করে জমিয়ে রাখতাম ৷ মেঝে জল দিয়ে পরিষ্কার করতাম,মনে হয় গরুদের আমরা যত্ন করতাম,তার সিকি ভাগও আমরা নিজেদের শরীরের জন্য করতাম না ৷ আমরা মাঝে মাঝে গোবর দিয়ে ঘুঁটেও দিতাম ৷ আমরা কোলকাতায় আসার আগে জানতামই না যে ঘুঁটে আবার বিক্রিও হয় ৷ আমরা তো জানতাম কুটির শিল্পের মতো যার যা ঘুটে লাগবে,সেটা নিজেরাই ঘরে বানিয়ে নেবে ৷ আমাদের বাড়িটা দেখতে সুন্দর হলেও সবার শোয়ার জায়গা হল না ৷ কাজেই আমি,অবশ্য এবার সেজদাও সঙ্গে ছিল ৷ ভিতর দিকের ছোট্ট বারান্দাটাকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা হল ৷ আর দু-পাশের দেওয়াল ঠেসে কোনো রকমে ঢোকানো হয়েছে একটা কাঠের চৌকি ৷ এই বানানো ঘরে ঢুকলেই তক্তপোশে উঠে পড়তে হবে ৷ মানে ঘরে ঢুকেই বিছানায় উঠে পড় ৷ এর উপর আবার আরেকটা জিনিস ছিল ৷ সদ্য জন্মানো গরুর বাচ্চা থাকত দরজা আর চৌকির মাঝের ছোট্ট জায়গাটায় ৷ আমাদের বিছানায় থাকত বই-এর পাহাড় আর ওরই মধ্যে আমাদের দুই ভাই-এর শোয়া আর অবশ্য পড়াশোনা ৷ সেজদার কাজ ছিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমাকে পিঠ দিয়ে ঠেলা ৷ ভাগ্যিস পাশে বাঁশের দেওয়াল থাকত ৷ নইলে তো একেবারে উঠোনে ৷ শোয়ার আগে মশারি অবশ্য টাঙাতে হবে ৷ টাঙোনোও হত ৷ আর গরুর বাচ্চাটার কাজ ছিল সারারাত ঐ মশারি চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া ৷ এক সময় দেখা গেল মশারির একদিকের দেওয়াল বলতে আর কিছুই নেই ৷ এখন হাসি পাচ্ছে যে এই ভেবে,একদিকের মশারির কিছু না থাকা সত্ত্বেও সেটা নিয়ম করে টাঙানোর বোকার মতো কাজটা আমরা নিয়মিত করে যেতাম ৷ 

বাড়িতে সবচাইতে আকর্ষণ ছিল ইলেক্ট্রিসিটি,তখন ক্লাশ নাইনে পড়ি ৷ আমাদের বারান্দা-ঘরে একটা বাল্ব লাগানো ছিল ৷ ওতেই আমরা দু-ভাই পড়াশোনা করতাম ৷ কিন্তু মুশকিল হল যে এই বাল্বের সুইচটা ছিল বাবার ঘরে ৷ সুইচ জ্বালাতে বা নেভাতে বাবার ঘরে যেতে হবে ৷ এতে আমাদের প্রায় দেড়-খানা ঘর ঘুরে যেতে হবে ৷ আমরা সন্ধ্যাবেলা নিজেরাই সুইচ অন করে আমাদের বারান্দা-ঘরে আসতাম ৷ কিন্তু রাতে লাইট নেভানোর জন্য চিৎকার করতে হত,যাতে কেউ একজন সুইচটা অফ করে দেয় ৷ আর একবার সুইচ অফ করার পরে,রাতে কোনো দরকারেই আর আলো জ্বালা যেত না ৷ কারণ ভিতরের সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যেত ৷ 

এভাবে চলল কিছুদিন ৷ তারপর আমার মাথায় একটা পোকা ঢুকল,কী করে সুইচটা আমাদের ঘরে বসেই নেভানো জ্বালানো যায় ৷ আগেই বলেছি আমাদের বাড়ির দেওয়ালগুলো ছিল বাঁশের বেড়ার উপর সিমেন্টের প্লাসটার করা ৷ আমি খেয়াল করে দেখলাম যে আমাদের ঘরের ভিতরের দেওয়ালের গায়েই বাবার ঘরের সুইচ বোর্ড ৷ ব্যাস দেওয়ালের ধার বরাবর একটা ছুরি দিয়ে সিমেন্ট তুলতে লাগলাম ৷ অনেকটা সিমেন্ট তোলার পরে দেখলাম ছুরিটা এফোঁড় ওফোঁড় ঢুকে যাচ্ছে ৷ সে দিন এ পর্যন্ত ৷ কারণ সরকারী দেওয়াল নষ্ট করতে নেই-এ ধারণাটা বাবা আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে ৷ 

এরপর চলল জিনিস খোঁজা ৷ শেষ পর্যন্ত একটা বাঁশের সরু এবং শক্ত কাঠি নিলাম ৷ সেই কাঠির মাথায় একদিকে একটা লোহার তার পেঁচালাম ৷ তারের একদিকটা একটা রিং-এর মতো করে আমাদের বাল্বের জন্য নির্দিষ্ট সুইচটাতে জড়িয়ে দিলাম ৷ তখনকার দিনে সুইচগুলো একটু উঁচু করা থাকত ৷ এবার কাঠিটার অন্য দিকটা দিলাম ঢুকিয়ে দেওয়ালের ফুঁটোটা দিয়ে ৷ ফিরে এলাম নিজের ঘরে ৷ এবার কাঠিটা আমাদের দিকের অংশটা নীচের দিকে চাপ দিলে সুইচটা উপরে উঠে যেত আর লাইট নিভে যেত ৷ কিন্তু কাঠির টানে সুইট সুইচটা ফিজিক্সেরে নিয়ম অনুসারে নীচু মানে অন করতে পারা যেত না ৷ যাইহোক এতে আমাদের মূল সমস্যাটা মিটে গেল ৷ সন্ধ্যাবেলা সুইচ অন করে দিয়ে ঘরে ঢুকতাম ৷ আর রাতে কাঠিটা রেলওয়ে সিগনালের মতো নীচের দিকে নামাতেই সুইচ অফ হয়ে যেত ৷ আর চিৎকার করে কাউকে ডাকতে হত না ৷ সেজদা একটু তারিফ করেছিল মনে হয় ৷ 

নাইনে ওঠার পরে আমার শরীরের পরিবর্তনটা মনের উপরেও খুব চাপ সৃষ্টি করেছিল ৷ সারাদিন সেই ব্যাপারটা আমাকে কষ্ট দিত ৷ আর সেটা গোঁফ বেরানো-টেরানো নয়,আমার হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট বা পাজামা পরা ৷ এতে প্রথম আমার যেটা বন্ধ হল সেটা হল ফুটবল খেলা ৷ কারণ ফুল প্যান্ট বা পাজামা পরে ফুটবল খেলা যায় না ৷ কারো বাড়িতে বিশেষ এমনিতেই যেতাম না ৷ এমনকি জ্যাঠামশায়ের বাড়িতেও যেতে ইচ্ছে করত না ৷ অন্য কারো বাড়িতে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে জামা খুলে স্নান করতে লজ্জা করত ৷ ব্যাপারটা কিন্তু কিছুই অস্বাভাবিক নয় ৷ আমার লম্বা আর টিনটিনে রোগা হওয়া ৷  পা গুলো লম্বা আর রোগা বলে হাফ প্যান্ট পড়তাম ৷ রোগা শরীরটা কেউ দেখে ফেলবে এরজন্য গরমের মধ্যেও জামা পরে ঘুমাতাম ৷ আমি কতটা রোগা ছিলাম সেটা বোঝার একটাই উদাহরণ দিলে যথেষ্ট ৷ আমি যখন ডাক্তারী কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় কমপক্ষে ওজন হতে হবে ৪০কেজি আর আমার ওজন ছিল ৩৫কেজি ৷ আমাকে অনেক হ্যাঙ্গার বলেও ডাকত ৷ 

স্কুলের কথা বেশী কিছু বলার নেই ৷ একেবারে গ্রামের স্কুল ৷ লম্বা ব্যারাকের মতো একটাই বিল্ডিং ৷ ভিতরে সব বাঁশের বেড়া দেওয়া ক্লাশ হিসাবে পার্টিশন দেওয়া ৷ ফুঁটো দিয়ে ওদিকের ক্লাশ দেখা ৷ তবে হেডমাস্টার মশাই উপেনবাবু স্যারকে আমার খুব ভালো লাগত ৷ ছোটখাট চেহারার মানুষটাকে এখনও আমি শ্রদ্ধা করি,যদিও তিনি বহু বছর আর নেই ৷ সবসময় সাদা খদ্দরের ইস্তিরি করা পাঞ্জাবী পরতেন ৷ আমার মতো হত চ্যাংড়া বান্ধা হাইস্কুলে একজন ছিলেন শিক্ষক আর বাদবাকি সব লোক ৷ একবার একজন নতুন দিদিমণি এলেন ৷ রোগা,কালো আর খ্যাঁচখ্যাঁচে ৷ আমার একটুকুও ভালো লাগত না ৷ কথায় কথায় বলত তোমরা কিছু জানো না ৷ ক্লাশে একটা ছাএও নেই যে একটু পড়াশোনা পারে ৷ আমিও সবে দোমহনী থেকে নতুন এসেছি ৷ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,কী করে জানলেন যে একটা ভালো ছেলে নেই ৷ দিদিমণি বোধহয় এতটা একজন নাইনের রোগা পটকা ছাএের কাছে আশা করেননি ৷ আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,তোমার দাদা কি ক্লাশ টেনে পড়ে ? অমল ? আমি বললাম হ্যাঁ ৷ 
দিদিমণি বলল,এই তো দুই ভাই আছো ৷ বাদ বাকি সব রদ্দি ৷

আমার তাতেও রাগ গেল না বললাম,কেন রদ্দি, ওরাও রীতিমত পাশ করে ক্লাশ নাইনে উঠেছে ৷ দিদিমণি আর কোনো কথা না বলে মুখচোখ লাল করে বেরিয়ে গেল ৷ কিছুক্ষণ বাদে হেডমাস্টার মশাই এলেন,শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় এসব নিয়ে কিছু বললেন ৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,নেতা হতে চাও তো বলো সামনের ইলেকশনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি ৷ ব্যাপারটা আরও অনেকদূর গড়িয়ে ছিল ৷ নাইন আর টেনের অনেক ছাএদের মধ্যেই দিদিমণি সম্বন্ধে নালিশ ছিল ৷ কেউ একজন হেডমাস্টারের কাছে বেনামীতে দিদিমণির নামে নালিশও এখন করেছিল ৷ দিদিমণিও স্কুল ছেড়ে চলে গেল ৷ এখন ভাবলে খারাপ লাগে ৷
ক্লাশের ছাএদের মধ্যে যদি একজন কাউকে বাছতে হয় তবে এক কথায় সুখা ৷ হয়তো স্কুলের খাতায় ওর নাম সুখাময় বা এমন কিছু ৷ কিন্তু ও সবার কাছেই সুখা ৷ সুখা দাস ৷ সুখার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার কোনো বিশেষ কারণ ছিল না ৷ আমরা এক পাড়ায় থাকতাম না ৷ ও ক্লাশের শেষের বেঞ্চে বসত ৷ পড়া জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকত ৷ এককথায় সরল সাধাসিধে ছেলে ৷ একটু বোকাও বলা যায় ৷ ওর সঙ্গে আমা বিশেষ কোনো ভালো বা মন্দ ঘটনাও ঘটেনি ৷ শুধুই বন্ধু ৷ 

আমি একটা অদ্ভূত জিনিস পরবর্তীকালে দেখেছি ৷ যে রকি, সুধা এবং পরে অন্যান্যরা এমন কী এই বয়সেও আমার বন্ধু হয় যারা সমাজের মাপকাঠিতে একটু নীচু রাস্তা দিয়ে হাঁটে ৷ মানে যারা পড়াশোনা,চাকরি বা অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শি হয়ে ওঠেনি আর্থিকভাবে দুর্বল তারাই হয় আমার সঙ্গীসাথি ৷ কেন এমন হয় আমি জানি না ৷ হয় আমি নিজে স্বমহিমায় মহিমান্বিত মানুষজনদের সঙ্গে হীনমন্যতায় ভুগি,অথবা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষরা আমাকে কাছে টানে ৷ আমি ওদের সাহায্য করার চেষ্টা করি ৷ এখনও যদি স্যুট-টাই পরা ডাক্তারের মিটিং-এ আমাকে যেতে হয়,আমার ইচ্ছে করে দারওয়ানের সঙ্গে আড্ডা দিতে ৷ বড়ত্ব আমার পোষায় না ৷ দু-বছর পরে আমি যখন ডাক্তারীতে ভর্তি হয়ে চ্যাংড়া বান্ধা গেলাম,তখনও সুখা স্কুলেই পরে ৷ ও একটা মজার কথা বলেছিল ৷ সেটা আমার এখনও মনে আছে ৷ ও আমাকে বলেছিল কমল,তুই ডাক্তারীতে ভর্তি হওয়ার জন্য অতদূর পয়সা খরচ করে গেলি ? আর আমার বাবাকে দেখ ৷ জানিস তো চ্যাংড়া বান্ধার একমাএ ডাক্তার ৷ আমার বাবা পড়াশোনা করত না বলে ক্লাশ এইটে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ৷ দু-বছর বাদে বাবা একটা,মোটা সহজে ডাক্তারী শেখানামে একটা বই নিয়ে ডাক্তার সেজে বাজারে দোকান খুলে বসে,এখন দেখ কেমন পসার ৷ তুই ও তো ওরকম একটা বই কিনে প্রাকটিস শুরু করতে পারিস ৷ 
আমি অবশ্য ওর কথার উওর দেইনি ৷
(ক্রমশঃ)
[কমলেন্দু চক্রবর্তী]



Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.