>

ফুল্লরা নাগ





সংশপ্তক:  বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়েবলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষবেলাকার গল্প চোরাই ধনে। যে যুগে কবি এই ধারণার তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন, ভিক্টোরিয়ান রোম্যান্টিক যুগচেতনায় লালিত জীবনবোধের আলোতে, আমাদের এই একবিংশ শতকের সময়চেতনায় সেই যুগের বাণী কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আপনার?
ফুল্লরা নাগ: বলা কঠিন... আসলে মনের নানা স্তর আছে ত! তার কোনো একটা স্তর হয় ত বিবাহ নামক বট বৃক্ষটি শিকড় গেড়ে ডালপালা ছড়িয়ে দখল করে আছে... কিন্তু জীবনের প্রতিটি  স্তরে তার সমান আধিপাত্য আছে বলে ত’ মনে হয় না... থাকলে স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে মানুষ বাঁচে কি করে?

সংশপ্তক:নরনারীর পারস্পরিক অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্কের  মূল রসায়নটা ঠিক কি বলে মনে করেন আপনি? বিবাহ নামক সামাজিক  প্রতিষ্ঠান কি সেই রসায়নের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে?
ফুল্লরা নাগ: না... যে রসায়নের ওপর সে টিকে থাকে সেটি কে যদি বর্ণনা করতে হয় তাহলে অনির্বচনীয় কথাটিই ব্যবহার করতে হবে... মনের কোন এক গভীরে কেমন করে যেন একটা যোগসূত্র তৈরী হয়... কে জানে সেই কি সেই মায়ার খেলা? বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি দুটি দেহকে কাছাকাছি এনে  হয়ত সেই যোগসূত্রটি কে মজবুত করতে সাহায্য করে... হয়ত বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে... আমাদের দেশে অন্তত... বিবাহ সেই যোগসূত্রটিকে জন্মও দেয়... কিন্তু বিবাহ যে তার অপরিহার্য অঙ্গ তা আমি মনে করি না...

সংশপ্তক:  দাম্পত্য সম্পর্ককে সুস্থসবল সজীব করে রাখার মূল শর্ত্তগুলি আপনার মতে কি কি?
ফুল্লরা নাগ: পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা... পরস্পরের কাজে সহযোগিতা... আর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ... কিন্তু সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন সেটা হল আত্মসম্ভ্রম... আরে আমি যদি নিজেকে শ্রদ্ধা না করি আমার স্বামী বা স্ত্রী আমাকে শ্রদ্ধা করবে কি করে? সেই জন্য ছেলেদের মত মেয়েদেরও নিজেদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে হবে... সেই পতির পূণ্যে সতির পূন্যের দিন কখনো ছিল না... আজকে ত নেই...সঙ্গে সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে যে... ব্যক্তিত্ববান হওয়া আর  স্বেচ্ছাচারী হওয়া এক নয়... ইংরেজিতে যাকে ডমিনেটিং বলে... তাও নয়... 

সংশপ্তক: আমাদের সমাজ বাস্তবতায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখী গৃহকোণ গড়ে ওঠে, দাম্পত্য সম্পর্কের আঙিনায় দুইজনের মধ্যে কোনো একজনের ব্যক্তিত্বের কাছে আর একজনের আত্মসমর্পণের ভিত্তিতেই। এইটা কি আদৌ কোনো  আদর্শ পথ বলে মনে করেন আপনি? বিশেষ করে যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংসারের মুখ চেয়ে স্ত্রীকেই আত্মসমর্পণ করতে হয় স্বামীর কাছে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে পুরুষতন্ত্রের কাছে?
ফুল্লরা নাগ: মেয়েটি যদি ব্যক্তিত্ববান হয় এবং দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা ঠিক থাকে তাহলে ক্ষতি হয় বলে ত মনে হয় না... কিন্তু কম ক্ষেত্রেই তাই হয়ে থাকে... দোষ কিন্তু অনেক সময় মেয়েদেরই... সন্সারের বাইরেও যে একটা জীবন আছে... নিজের প্রতি তার একটা কর্তব্য আছে সে অনেক মেয়েই মাথায় রাখে না... তাই অনেক সময়ই সে স্বামীর প্রয়োজনের কাছে নতি স্বীকার করে... তারপর  হয় আত্মগ্লানিতে ভোগে... কিম্বা একটা অর্থহীন জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পরে...

KREUTZER SONATA) বলেছেন “…a marriage without love is no marriage at all, that only love sanctifies marriage, and that the only true marriage is that sanctified by love” এখানেই প্রশ্ন জাগে এইটাই তো হওয়ার কথা, আর সেইক্ষেত্রে বিবাহের পরিণতি তো কখনোই বিয়োগান্ত হতে পারে না! তবে  সমাজে এত বিবাহ-বিচ্ছেদের বারবাড়ন্ত কেন?
ফুল্লরা নাগ: ভাললাগাকে ভালবাসা বলে অনেক সময়ই আমরা গুলিয়ে ফেলি... তাছাড়া একটা সম্পর্ক জিয়ে রাখতে দুপক্ষকেই যে বলিদান দিতে হয় সেটা দিতে চাই না বলে... সবচেয়ে বড় কথা বিচ্ছেদ বলে একটা অপসন আছে বলে...

সংশপ্তক: সাধারণভাবে বিবাহ বলতেই আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকেই বুঝিয়ে থাকি। এই যে একটি সম্পর্কের বন্ধন বা শৃঙ্খল এবং তাতে আজীবন আবদ্ধ থাকার প্রাথমিক অঙ্গীকার, সেই শৃঙ্খলই কি কোন এক সময় দাম্পত্যের পরিসরটিকে সঙ্কুচিত করে তুলে একটা দমবন্ধের পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে, যা অধিকাংশ বিবাহবিচ্ছেদের মূলে ক্রিয়াশীল থাকে বলে মনে হয় আপনার?
ফুল্লরা নাগ: কে জানে বাপু... আমার ৩৩ বছরের বিবাহিত জীবনে কখন ত দম বন্ধ অনুভব করি নি... আসলে আমি কখনই ভাবি নি আমার স্বামী একদম আমার মনের মত হবে... সে যে দোষে গুণে আলাদা একটা মানুষ... তার আলাদা একটা ব্যক্তিত্য আছে... সেটা আমি প্রথম থেকেই স্বীকার করে নিয়েছিলাম... তাকে কোনদিন বদলাতে চাই নি... সেও আমায় কোনোদিন বদলাতে চায় নি... আমি আমিই... সে সে.. এইটিই বোধ হয় ছিল আমাদের বিবাহিত জীবনের রসায়ন...

সংশপ্তক:  সাধারণ ভাবে বিবাহ বলতে দুটি নরনারীর এক সাথে বসবাস ও বংশরক্ষা, সংসারধর্ম পালন বলেই বুঝে থাকি আমরা।  কিন্তু এই সামান্য জৈবিক পরিসরেই তো বিবাহের সার্থকতা পূরণ হতে পারে না! দুজন মানুষের মানসিক, শারীরীক, মনস্তাত্বিক ও আত্মিক সত্ত্বাগত মিলন ছাড়া তো বিবাহ সম্পূর্ণ হতে পারে না!  বর্তমান সমাজ সংসারের প্রেক্ষিতে দুইজন মানুষের এই সত্ত্বাগত মিলন কতটা বাস্তবিক সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?
ফুল্লরা নাগ: সত্যি বলব? এ আপনার এক অসম্ভব প্রস্তাব... এ কবির কল্পনায় থাকতে পারে... বাস্তবে কখন ছিল না... নেই... থাকবেও না...

সংশপ্তক: বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্পর্কের আঙিনায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই মনে হয়বিশেষ করে দাম্পত্যের পরিসরে তো বটেই। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে তার লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারউপন্যাস প্রসঙ্গে লরেন্স এক জায়গায় বলেছিলে, “The modern cult of personality is excellent for friendship between sexes, and fatal for marriage” অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকেই তিনি সফল দাম্পত্যের অন্তরায় বলে মনে করছেন। নাকি দাম্পত্যের পরিসরে নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকে পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে অপারগ বলেই  দাম্পত্যে এই আধুনিক সংঘাতের সৃষ্টি বলে মনে হয় আপনার?
ফুল্লরা নাগ: এর উত্তর বোধ হয় আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি...

সংশপ্তক:   একজন বিবাহ বিচ্ছিন্না নারী ও বিবাহ বিচ্ছিন্ন পুরুষকে সমাজ কি একই চোখে দেখে বলে মনে করেন আপনি? বাস্তব অভিজ্ঞতায় কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর সম্বন্ধেই দোষারোপ করা হয় মানিয়ে নিয়ে চলতে না পারার জন্যেই! অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয় যে সফল দাম্পত্যের অন্যতম শর্ত হল নারীর এই মানিয়ে নিয়ে চলার ক্ষমতা, যা অন্যদিক দিয়ে পুরুষতন্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর। এই বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
ফুল্লরা নাগ: আমি মনে করি বেশীর ভাগ বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারী পুরুষ কেউই দায়ী নয়... বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দুটো পারসোনালিটির মিসম্যাচের জন্যই বিয়ে টেকে না... কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য কোনো একপক্ষের সঙ্কীর্ণতা বা হিন্যমনতা বা অন্য কিছু এর জন্য দায়ী।

সংশপ্তক: দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙন সন্তানদের চেতন অবচেতনে কি একটা অনিশ্চিয়তার জন্ম দেয় না? সেই অনিশ্চিয়তা যদি তাদের সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায় তবে তাদের পরবর্তী জীবনে তার প্রভাব কতটা সদর্থক বা নঙর্থক হয় বলে মনে হয় আপনার?
ফুল্লরা নাগ: ওরে বাবা, এ ত জটিল মনস্তাত্বিক প্রশ্ন... এটা কিন্তু এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম প্রভাব ফেলে ... তবে বেশির ভাগ বাচ্চাই মনে হয় কাটিয়ে ওঠে... মানব মনের অসীম ক্ষ্মমতা।

সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতিদের মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব স্ত্রীই বহন করেন। সন্তানের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মার সাহচর্যই অধিকতর প্রয়োজনীয় হলেও শিশু মনে পিতার অভাব কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে? সেই ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
ফুল্লরা নাগ: অন্তত পিতার অযথা নিন্দা থেকে বিরত থাকা উচিত...

সংশপ্তক:  আমাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যার এই যে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাগরিক সমাজের পক্ষে তা কতখানি ক্ষতিকর বলে মনে করেন আপনি? নাকি এই পথেই নতুন সমাজ বিন্যাস গড়ে নেবে অনাগত ভবিষ্যৎ?
ফুল্লরা নাগ: নেবে...

ফুল্লরা নাগ: প্রাবন্ধিক সুলেখিকা!


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.