>

সোমা মুখোপাধ্যায়

SongSoptok | 11/15/2016 |



তারে যায় না সওয়া
যায় না বওয়া
সে অন্তরেতে রয়
গভীর গোপনময় .....
                     
                হ্যাঁ, সেক্স নামক কর্মটি বা অনুভূতিটি এইভাবেই মনে থাকে যখন দেখি তাকে এক জীববিজ্ঞানী বা শরীরতত্বানুসন্ধানীর দৃষ্টি দিয়ে। আমাদের পুরাতন শাস্ত্রেও আহার-নিদ্রা-ক্রীড়া-মৈথুন এই ছিল প্রধান কথা যা জীবকুলের অস্তিত্বের মূলমন্ত্র। কাজেই এই চারটির কোনোটিতেই কোনো বিধি-নিষেধ গ্রাহ্য হওয়ার কথা নয়। মৈথুন শুধু সঙ্গম নয়, অন্যভাবে একটি ক্রীড়াও যার মধ্যে আছে শারীরিক ও মানসিক আনন্দানুভূতি, দোসরের সাথে একটা নিকট নিবিড় সম্পর্ক যা একে অন্যকে এনে দেয় অনেক কাছে।   আবার মৈথুন যৌনতার একটি দিক, সর্বাঙ্গিক রূপ নয়; এর আগে রয়েছে রতি। একসময়ে সমাজে অন্য জীবেদের মতোই অবাধ ছিল মনুষ্যপ্রাণীর সঙ্গম যা প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী বংশরক্ষার প্রকৃতিসৃষ্ট প্রক্রিয়া ভ্রুণের কাছে শুক্রাণুকে পৌঁছে দেবার সহজ রীতি। মানুষ যেহেতু সামাজিক প্রাণী সমাজের চোখ অনেকসময়ই অন্তরের চোখকে বদলে দেয়। মৈথুন, যৌনতা অথবা রতি শব্দগুলো তাদের কৌলিন্য হারিয়েছে আমাদের ভাষায়, সেক্স, ইন্টারকোর্স ও ফোর-প্লে না বললে অন্য শব্দগুলোকে কিরকম নিচুতলার অশ্লীল শব্দ বা কার্যকলাপ বলে ধরে নেওয়া হয় ইদানিংকালে। সূক্ষ্ম অনুভূতিস্থল থেকে আমরা বলি প্রেম ভালোবাসা ও পরে দৈহিক সম্পর্ক। যদিও প্রেম ও যৌন সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত শুধু নয় অনেক ক্ষেত্রেই প্রেম ও ভালোবাসাটি প্রস্ফূটিত হবার চেয়ে প্রাধান্য পায় শরীরের একাত্মতা। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ ঘাঁটলেই এর উদাহরণ মিলবে ভুরি ভুরি। দুষ্মন্তের সাথে শকুন্তলার দেখা বনের মাঝে এবং তারপরই দেখি শকুন্তলা অন্যস্বত্বা। মহাভারত যাই বলুক অস্ফূট সত্যটি আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় না কুন্তীর গর্ভ বার বার ভরে উঠেছিল কোন দেবতার সঙ্গমে!

                শুধু আমাদের দেশের সভ্যতার ইতিহাসে নয়, সারা পৃথিবীর ইতিহাস ও মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারা যদি দেখি তাহলে এটা খুৱ-ই পরিষ্কার যে সেই আদিম সময় থেকে মানুষের ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ও নারী পুরুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী সঙ্গী বেছে নেবার। প্রায় ২০০ থেকে ৪০০ বছর খ্রীস্টপূর্বে হিন্দুদের প্রকাশিত গ্রন্থ বাৎস্যায়নের কামসূত্র যদিও সারা পৃথিবী জুড়েই জনবিদিত যাকে ধরা হয় যৌন মিলনের, অভিব্যক্তির ও পুরুষ-রমণীর রমনানুরাগের পরিভাষা ও অভিধান। কিন্তু লোকেরা যেটি খেয়াল বা উল্লেখ করে না তা হলো বাৎস্যায়নের কামসূত্র শুধু মাত্র যৌন সঙ্গমের বিস্তারিত বিবৃতি নয়, তাকে ধরা হয়েছে মানুষের সম্পর্কের ও সমাজ গঠনের মাধ্যম। ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চারটি হলো জীবনের লক্ষ্য এই উল্লেখ রয়েছে বাৎস্যায়নের লেখায় এবং এতে আছে বৈবাহিক বন্ধন ও সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা। কাজেই এইসময় থেকে ধরা যেতে পারে সমাজের বা সমাজপতিদের দৃষ্টি থেকে বহুবিবাহ বা একাধিক সম্পর্ক হতে একমুখিনতার দিকে ধীর পদক্ষেপ।

             ইতিহাসে খুঁজলে দেখা যায় শুধু আর্য সমাজ নয় পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত গোষ্ঠীতেও সঙ্গম-মৈথুনে নারী পুরুষের একই ভূমিকা ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব শতকে যখন বাৎস্যায়ন কামসূত্র রচনা করছেন, যখন সেই কামসূত্র পড়ে হিন্দুসমাজে কামনার শিখা উঠছে, সেই সময়ের আসে পাশেই ইউরোপে বিশেষ করে রোমে তখন একাধারে উন্নতি ও অন্যদিকে উশৃংখলতার তুফান।  রোমানদের মধ্যে ছিল অবাধ সম্পর্কের চল যার একটি বড় উদাহরণ ক্লিওপেট্রা। সীজারের সামনে প্রথম প্রকাশেই ছিল নাটকীয়তা, কার্পেটের থেকে নগ্ন শরীরে রাজসভাস্থলে বেরিয়ে আসেন ক্লিওপেট্রা। তার আগে নিজের ভাই-এর সাথে বিবাহ ও সন্তান এসে গেছে। তারপরে সীজার এবং মার্ক এন্টোনির সন্তানের জন্ম দেন ক্লিওপেট্রা। গ্রীক, রোমান ও মিশরীয়দের মধ্যে অন্তর্মহলে অবাধ যৌনমিলনের প্রচলন ছিল রয়্যাল রক্ত সংরক্ষণের জন্য। তার পরিণতি অবশ্য সুবিধেজনক হয় নি কারণ জেনেটিক্স-এর তত্ব বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে পরিবারের মধ্যে কোনোরকম অসুস্থতা কতগুণ বেড়ে ফারাওদের অবলুপ্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

              কিছু মনস্তত্ববিদের মতে মানুষের শিল্প-ভাস্কর্য সৃষ্টির মূলে প্রতিভার সঙ্গে একটি মানসিক ধারণার যোগাযোগ আছে। অন্য প্রাণীদের মতো স্ত্রী বা পুরুষের একে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যখন পেখম বা পালক বা পাপড়ি নেই তখন মানুষের এই এক উপায় একে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের ও প্রেম নিবেদনের। পুরাতাত্বিক নিদর্শন দেখলে দেখা যায় যে গাছের ছাল বা পশুর চামড়া ব্যবহার করে মানুষের বস্ত্রের প্রচলন হয়েছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ বা তারও কিছু আগে। কিন্তু মিশরীয় সভ্যতা থেকে যখন দেখি চিত্র রাজার সভায় নর্তকীদের দেখা যেত নগ্ন শরীরে এবং তারপরে গ্রীক ও রোমান ভাস্কর্যে প্রথমে দেখা যায় পেশীবহুল নগ্ন যোদ্ধা ও ক্রীড়াবিদদের মূর্তি। আশ্চর্যজনকভাবে নারীমূর্তি নগ্ন রূপে গ্রিক ও রোমান শিল্পে প্রথমে আসে দেবীমূর্তিতে - ভেনাস ও আফ্রোদিতি। গ্রীকেদের মধ্যে মনমতো সঙ্গী নির্বাচনের চল ছিল ও তার সাথে চল ছিল স্বচ্ছন্দ মেলামেশা ও যৌনমিলনের। বিলুপ্ত পমপেই শহরের ফ্রেসকো যখন আবিষ্কৃত হলো নারী-পুরুষের মিলন, শরীরের ভিন্ন-ভিন্ন কাজ ও মিলনকালের অঙ্গবিন্যাস তুলির আখরে যে কত শৈল্পীক রূপ পেয়েছিলো তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হয়।

              অথচ মোটামুটিভাবে ১০০ খ্রীষ্টপূর্বের এই দেওয়াল শিল্পকে তখন আখ্যা দেওয়া হলো এসব নিশ্চয়ই বারবণিতাদের যৌনআবেদনের বিজ্ঞাপন কিভাবে তাদের কাছে পুরুষ পাবে অনির্বচনীয় আনন্দ; অতএব নিম্নরুচির শিল্প । কিন্তু পমপেইতে নারী পুরুষের মিলনের ছবি, মূর্তি, দেওয়ালচিত্র, ঘর সাজানো সব কিছুতে খুবই প্রচলিত ছিলক্রমে ক্রমে সমাজে নিয়ম চালু হতে শুরু হয় কখন পোষাক পরা ও না পরার রীতিআস্তে হতে থাকে প্রচলন একবিবাহের কিন্তু দাস হলে তাদের নগ্ন শরীর দেখার ও মালিকের ইচ্ছানুযায়ী ভোগের।

                 পূজ্য দেবতা, শিল্প, মিলন ও সমাজে এসবের গ্রহণযোগ্যতা কতটা আলোচনা করতে গেলে ভারতবর্ষের খাজুরাহের মন্দিরের কথা চলেই আসে। রাজানুকূল্যে কত অর্থ, শিল্পকলা এবং ভালোবাসা-কামনা-যৌন অভিব্যক্তি কত সময় ধরে নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা সবদিক দিয়ে ভাবলে বিস্ময়জনক। এখানে যৌন আবেদন, শারীরিক নিবেদন ও তৃপ্তি পরিস্ফূট এবং ও পরিস্ফুট যে তৎকালীন চান্দোলা সমাজ এই নিয়ে কোনো সংকোচ বা গোপনীয়তার আশ্রয় নেই তো নি, বরং মাথা উঁচু রেখে পর্বত শিখরে খোদাই করে রেখেছে তাদের মনের কথা। সেই মহেঞ্জোদাড়ো আমল থেকে খাজুরাহো মন্দিরের প্রস্তর মূর্তিতে আমরা দেখতে পাই আদি

                 দেবতা হিসেবে শিবের খোদাই মূর্তি যদিও এই দুই -এর মাঝে যে শুধু হাজার হাজার বছরের ব্যবধান তাই নয় আছে ভাবনারও ব্যবধান; মহেঞ্জোদাড়ো থেকে আমরা জানতে পারি তারা ছিলেন শৈব কিন্তু খাজুরাহের মন্দিরে খাজুরাহো বা খর্জুরবাহক বা শিবের যে মূর্তি খোদিত তা নারী-পুরুষের আকাঙ্খার ও যৌন-মিলনের শৈল্পিক রূপ। মহাদেবকে আমরা যখন দেখি  নটরাজরূপে তাঁর নৃত্যভঙ্গী অপরূপ। খাজুরাহের গুহাশিল্পে যে মূর্তি দেখি তা কামনার ও বহুমিলনের খোদিত রূপ যেখানে নৃত্যভঙ্গিমা ও কামমহিমা দুইয়েরই অসম্ভব সুন্দর সমন্বয়। ঐতিহাসিক ও সমাজবিদরা একমত যে পাহাড়ের এই শিল্প এই তথ্য প্রকাশ করে যে এই মিলনের বা আনন্দানুভূতি আহরণে নারী পুরুষ সমান ভাবে অংশগ্রহণ করত। তবে অদ্ভুত বৈপরীত্য ফুটে ওঠে এই ভাবনায় যে চান্দেলা রাজত্বে শিব ছিলেন যোদ্ধা রাজাদের পূজ্য যিনি বহুমিলনেও কামনার মাঝে এক সৌন্দর্য্যের প্রতীক। আর পরবর্তীকালে দেখতে পাই এই নটরাজ একপত্নী উমার ভোলানাথ স্বামী। কাজেই বিভিন্ন যুগে তথাকথিত সমাজরক্ষকের হাতে বদল হয়েছে সমাজে  নারী পুরুষের মিলনের প্রথা ও তারসাথে  দেবতার অবয়ব।

            শুধু খাজুরাহো নয়, জনসমক্ষে প্রদর্শনীর রীতির ও অভিব্যক্তির এক বিস্ময়কর সমন্বয় দেখা যায় জাপানের কায়াসাকির কানায়মা শ্রাইন-এ।  কানামারা মাতসুরি উৎসবকে জাপানের বসন্তোৎসব বলা যায় যেখানে সারা শহর ও অঞ্চল ভরে যায় লিঙ্গ শয্যায় ও শোভাযাত্রায়। এ এক অন্য দৃশ্য। আমাদের হিন্দু সমাজেও মহাদেব একদিকে সৃষ্টি-প্রলয়-তেজ বিষ-বিঘ্ননাশক ত্রিলোকেশ্বর সর্বভবপশুপতি আবার তিনিই প্রজাপতি যিনি কাম-পরমানন্দ ও প্রজননের প্রতিরূপ - শিবলিঙ্গ। কিন্তু তাঁকে অন্যভাবে পুজো করা হয় যদিও তা সাংকেতিক, কিন্তু কানামারা মাতসুরিতে সরাসরি স্বাভাবিক চাহিদার ও আকর্ষণের পরিষ্কার অভিব্যক্তি কোনো পর্দার আড়াল না রেখে। এরকম লিঙ্গ-শোভা অবশ্য গ্রীক ও রোমান আমলেও দেখা যেত, পূজোর মোমবাতি, উইন্ড-চাইম তৈরী হতো পুরুষাঙ্গের আকৃতিতে। এমনকি পমপেইতে এরকম ব্যবহারে যোনির আকৃতিতেও সামগ্রী দেখা গেছে। আমাদের হিন্দু সমাজেও যোনি পূজার চল আছে, যদিও বলা হয় সেটা কাপালিক বা তন্ত্রসাধকদের মধ্যেই প্রচলিত।  সেই জন্য অনেক পুৰাতাত্বিকদের ধারণা হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের থেকে চান্দেলা রাজাদের মধ্যে তান্ত্রিক রীতি বেশি ছিল এবং খাজুরাহোর মন্দিরগাত্রের মূর্তিতে তাই শুধু যৌন সঙ্গম নয় যৌন অঙ্গেরও সুন্দর সজ্জা দেখা যায়।

                লিঙ্গ প্রসঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে চলে আসে বীর্য ও ঔরস প্রসঙ্গ যা আমাদের হিন্দু ধর্মে সেই আদিকাল থেকে জড়িত। জৈবিক দিক থেকে সেক্স-এর প্রয়োজন প্রজনন বা বংশবিস্তারে।  ভ্রুণটি যেহেতু পর্দানশীন এবং বীর্যটি দৃশ্যমান ও বহমান তার উল্লেখ অন্যভাবে। সে পুরাকালের কথায়  বারবার পড়েছি ঊর্বশী, রম্ভার সৌন্দর্য ও নৃত্যে দেবতাদের বীর্যপাত হয়ে যেত। রাজাদের বর্ণনাপ্রসঙ্গে বিশেষণ দেওয়া হতো শৌর্য-বীর্যের অধিকারী। কখনো বর্ণনা ছিল পরিষ্কার আবার কখনো বা কোনো রুপার্থকভাবে প্রয়োগ হতো।  রামায়ণ-মহাভারতে রাজাদের প্রজননে অক্ষমতা থাকলে মুনি-ঋষিদের আহ্বান করা হতো, কারণটা-কি স্বচ্ছ। কিন্তু বিবরণে বলা হতো  যেমনযজ্ঞের থেকে উঠে এলেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি হাতে চরু বা পায়েস এবং রানীরা গর্ভবতি হলেন তাঁর আশীর্বাদে ইত্যাদি ইত্যাদি। বীর্যপাতকে অনেকে অশ্লীল বলে ধরেন; হ্যা জনসমগ্রে সেটা হলে বা করলে রুচিবিহীন ঠিক কথাই কিন্তু আবার যদি ফিরে আসি শরীরতত্বে তাহলে এটাও পুরুষের জৈবিক প্রক্রিয়ার একটা অঙ্গ তার স্বাস্থ্য বজায় রাখার। আমাদের পুরাণ ও মহাকাব্যের এই মেলামেশার কাহিনী নিয়ে যখন নারায়ণ সান্যাল তাঁর উপন্যাস লিখেছিলেন অশ্লীলতার দায়ে তখন অনেক সমালোচনা ও কটূক্তি তাঁকে শুনতে হয়েছিল।  এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলেছিলেন দেবী সরস্বতীর মূর্তি দেখলে তাঁর কামনা জাগে, সমাজে গুঞ্জন হতে হতে তা আইন আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছিল ধর্মীয় বিশ্বাস-এর অবমাননার জন্য, যদিও সে অভিযোগ ধোপে টেঁকে নি কারণ আধুনিক জাজটি বলেছিলেন এ সম্পূর্ণই তাঁর নিজের অনুভূতির অভিব্যক্তি। অথচ আমরা যদি সরস্বতী পূজোর শ্লোকে একটি উদাহরণ দেখি – “কুচযুগশোভিত মুক্তা  হারে”, দেবীর উন্নত বক্ষের শোভা এনেছে মুক্তার হার সেটিই হয় পরিষ্কার।

            আগেই বলেছি মানুষ যেহেতু সামাজিক প্রাণী সমাজের চোখ অনেকসময়ই অন্তরের চোখকে বদলে দেয়। এই প্রসঙ্গে লেখা চল্লিশ-এর দশকে সারা ভারতবর্ষে সাহিত্যে ও সমাজ-দর্শনে সাড়া জাগাল রাহুল সাংকৃত্যায়ন-এর বই "ভোলগা সে গঙ্গা"। রাহুল সাংকৃত্যায়ন-এর এই বই মানুষের সামাজিক বিবর্তনের এক প্রামাণ্য দলিল বললেও ভুল বলা হবে না।  বহু বছরের বহু গবেষণা, ও উত্তরে রাশিয়া থেকে ক্রমে দক্ষিণ দিকে আর্য  সভ্যতার পথ ধরে পর্যটন করে ও ভাষা শিখে খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০  থেকে শুরু করে প্রায় ছয় হাজার বছরের মানব সভ্যতা, ধর্মের আবির্ভাব, নারী-পুরুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিগত সহজাত সম্পর্ক ও যৌন মিলন সব কিছু নিয়েই লিখেছিলেন এই বই ভোলগা সে গঙ্গা যা পরে বাংলা থেকে শুরু করে একাধিক ভারতীয় ভাষা সহ ইংরেজি, রাশিয়ান ও অন্য বিভিন্ন ভাষাতে অনূদিত হয়। এই বইতে পরিষ্কার ভাবে লিখেছেন যে সভ্যতার প্রথমদিকে মানবসমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক এবং সম্পূর্ণরূপে মেয়েরা নিজেরাই অবাধ স্বাধীনতায় যৌন মিলনে ও সন্তান জন্মের নিয়ামক। তারপর সমাজ বদলে যেতে থাকে শারীরিক ক্ষমতার প্রভাব থেকে ক্রমশ পুরুষতান্ত্রিক ও নির্ধারিত সমাজ ব্যবস্থায়। সেই সময়ে তীব্র সমালোচনা, নিন্দা ও কৌতূহলের্ উদ্রেক করেছিল এই গ্রন্থ এবং অনেকেই কন্যা বা মহিলার অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও আপত্তি তুলেছিল। কারণ বিংশ শতকে হিন্দু, মুসলিম খ্রীষ্টান কোনো সমাজই মেয়েদের ইচ্ছামিলনে  স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিল না।

                সমাজের অগ্রগতির বা বিবর্তনের সাথে খৃষ্টোত্তর যুগ থেকে ক্রমে ক্রমে নারী-পুরুষের উভয়ের সমান ভূমিকার থেকে পুরুষের দিকেই পাল্লা ভারী হয়ে গেছে। এর পরিবর্তনের জন্য ষাটের দশকে আমেরিকাতে এলো সেক্স রেভোলুশন। এলো প্লে- বয় ম্যাগাজিন, নির্মিত হতে শুরু হলো কামনা-উদ্দীপক মুভি যেগুলির নির্মাতা ছিলেন প্রথমদিকে আন্ডি ওয়ারহল বা উডি অ্যালেন-এর মতো প্রতিভাবান শিল্পীরা। পুরুষাঙ্গ, নারী-অঙ্গ যেমন প্রকৃতিসৃষ্ট তেমনি কিন্তু বিবর্তনের ধারা অনুযায়ী মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কামোদ্যিপক অঙ্গ হলো মস্তিষ্ক যা পরিচালনা করে সেক্স-ড্রাইভ বা রতি-মৈথুন। সবার প্রথম এই বিষয়টিকে নিয়ে একটি অসাধারণ ফিল্ম বানিয়েছিলেন উডি অ্যালেন যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক তথ্যকে এমন সুন্দর শৈল্পিক রূপ দেওয়া হয়েছিল যা  তার প্রতিভারই প্রকাশ। আমাদের ছোটবেলায় মনে আছে শুরু হলো "A" মার্কা বই আসা আমাদের দেশে। এসেছিলো গুপ্ত জ্ঞান” -পাগলের মতো ভিড় হয়েছিল যৌনতৃষ্ণার্ত কৌতূহলী মানুষের। দুটো সিনেমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে এই প্রসঙ্গে - ষাটের দশকে বাংলায় "নিশি-পদ্ম" ও ৭০-এর দশকে হিন্দিতে "জুলি"; অনেক ছোট ছিলাম দেখার কোনো সুযোগই ছিল না। নিশি পদ্ম দেখার ইচ্ছে ছিল গল্পটার জন্য এবং উত্তম-সাবিত্রীর অভিনয়ের জন্য, যখন দেখেছিলাম শুধু বারবণিতার পাড়া ছাড়া অন্যকোনরকম কোনো দৈহিক আবেগের সিন্ও ছিল না। আর যা শুনেছি জুলিতে ছিল সদ্য মা-হবার পর নায়িকার স্তনের কাছে ভেজা জামা। সেভাবে যৌন আবেদনমূলক কোনো দৃশ্য না থাকলেও না পাওয়া বা লুকোনো জিনিসের উপর মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন, কাজেই ব্যবসায়িক সাফল্য এসেছিলো এই দুটির ক্ষেত্রেই। এই সময়ের কাছাকাছি যদিও "বিবর" উপন্যাস ও বারবধূনাটক সত্যি চাঞ্চল্য জাগিয়েছিল বাঙ্গালী সমাজে। উপন্যাস-শিল্প-সাহিত্যের বাইরে মেয়েদের নিজেদের জীবনের আনন্দ উপভোগ করার জন্য বাস্তবে যার অবদান অনেক তিনি হলেন ক্যাথারিন ম্যাককর্মিক। সত্তর বয়স্কা বিত্তশালী এই সেই বিজ্ঞানী যার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও অর্থে আবিষ্কৃত হয় বার্থ কন্ট্রোল পিল।

           সমাজের চোখে ভালো ও মন্দের মাপকাঠিতে ট্রাপিজের দোলায় দুলে চলেছে এই প্রসঙ্গ সেক্স যার প্রয়োজন মানুষ এক প্রাণী হয়ে কোনোদিনই অস্বীকার করতে পারবে না। তবে প্রকাশ্যে এই আবেগের প্রকাশ কিভাবে প্রদর্শিত হবে তার নানারকম আলোচনা, নিয়ম, মাপকাঠি আরোপিত হয়েছে পরিচ্ছন্ন সমাজ বজায় রাখার জন্য। এই প্রেম-আবেগ-আকর্ষণ যতক্ষণ মধুর তার মধ্যে রয়েছে স্বর্গীয় সৌন্দর্য, তাঁকে অমানবিক বেড়াজালে বাঁধা যেমন অস্বাভাবিক তেমনি যখন তা রুচিবিহীন হয়ে সমাজের কালো দিককে তুলে ধরে তখন আমাদের সৌজন্য, বোধ, বিবেক ও সংস্কৃতির মর্যাদায় আঘাত হানে। ফেস বুকের অনেক সুন্দর অবদান এখন পৃথিবী জুড়ে অথচ বেশ অনেক সংখ্যক মানুষের কাছেই এ এক ফেক বুক ও সেক্সবুক হিসেবে গণ্য বাধাবিহীন বিচরণভূমি। এক সময়ে খেলোয়াড়ের বা সৈনিক-এর নগ্ন চেহারায় চওড়া কাঁধ ও উন্নত গ্রীবার প্রদর্শনীতে যে অহংকার ও মর্যাদা ফুটে বেরোতো সেই নগ্ন শরীরকে যখন দেখি ব্যবহার করা হয়েছে ক্রীতদাস এর মূল্য নির্ণয়ের জন্য অথবা  নগরপতির আজ্ঞায় কোনো মেয়েকে দশ বা পনেরো পুরুষের কামনার ধর্ষণের স্বীকার হবার পরও নগ্ন শরীরে আবার সারা গ্রাম ঘোরানো হয়েছে সেই শারীরিক ও মানসিক ভাবে ছিন্নভিন্ন মেয়েটিকে বা বধূটিকে তখন সমস্ত মানুষের অবমানিত আত্মার অন্তর  থেকে মনে হয়েছে কোথায় সে প্ৰেম-মধুর স্বর্গীয় আবেগ, রুদ্ধ করে দেওয়া হোক মানুষের এই নারকীয় প্রবৃত্তিকে। 

Refrences:
https://www.youtube.com/watch?v=TrYWHXC1bI0
https://www.theguardian.com/artanddesign/jonathanjonesblog/2016/nov/03/on-the-origins-of-art-exhibition-tasmania-why-did-humans-start-making-art-comment
https://en.wikipedia.org/wiki/Erotic_art_in_Pompeii_and_Herculaneum

Acknowledgement for pictures:
https://en.wikipedia.org/wiki/Erotic_art_in_Pompeii_and_Herculaneum#/media/File:Polyphemus_and_Galatea_kissing,_Pompeii.jpg
https://www.google.com/search?q=H%C5%8Dnen+Matsuri


ডঃ সোমা মুখোপাধ্যায়  (অগাস্টা, জর্জিয়া)

Comments
1 Comments

1 comment:

  1. বিস্মিত ও সমৃদ্ধ হলাম তোমার লেখা প্রবন্ধ ''তারে যায় না সওয়া'' পড়ে। তুমি একজন জীব বিজ্ঞানী; কিন্তু তোমার প্রবন্ধে দেখলাম ভারতীয় পুরান, দর্শন, ইতিহাস এবং সেইসাথে পাশ্চাত্ত দর্শন ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে তোমার অনায়াস স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তোমার অধ্যয়ন ও জ্ঞানের গভীরতা দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। এখন অবধি তোমার যেসব লেখা পড়েছি , ''তারে যায় না সওয়া'' প্রবন্ধটি তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে মনে হলো।অনেক অনেক অভিনন্দন গ্রহণ কোরো।

    ReplyDelete

Blogger Widgets
Powered by Blogger.